বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বিশেষ এক শ্রেণীর ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। এগুলো খ্রিষ্টীয় পঞ্চাদশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত পৌরাণিক, লৌকিক ও পৌরাণিক-লৌকিক সংমিশ্রিত দেবদেবীর লীলামাহাত্ন্য,পূজাপ্রচার ও ভক্তকাহিনী অবলম্বনে সম্প্রদায়গত প্রচারধর্মী ও আখ্যানমূলক কাব্য। মঙ্গল শব্দটির আভিধানিক অর্থ কল্যাণ। যে কাব্যের কাহিনী শ্রবণ করলে সর্বধিক অকল্যাণ নাশ হয় এবং পূর্ণাঙ্গ মঙ্গল লাভ ঘটে তাকে মঙ্গলকাব্য বলে। বিভিন্ন দেবদেবীর গুনগান মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য। তন্মধ্যে স্ত্রীদেবতাদের প্রাধান্যই বেশি এবং মনসা ও চন্ডীই এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
লৌকিক দেবদেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত মঙ্গলকাব্যগুলোতে চারটি অংশ থাকে-
- বন্দনা
- গ্রন্থ রচনার কারণবর্ণ্না
- দেবখন্ড
- নরখন্ড বা মূলকাহিনী বর্ণ্না
বারমাসী ও চৌতিশা জাতীয় কাব্যাংশ মঙ্গলকাব্যে স্থান লাভ করত।কবি কাব্যে নিজের পরিচয় ও উল্লেখ করতেন।মঙ্গলকাব্য প্রধানত কাহিনীকেন্দ্রিক। মূলকাহিনীর সঙ্গে দেবলীলা, ধর্মমত্ত্ব ও নানা ধরনের বর্ণ্নায় এসব কাব্য বিপুলায়তন লাভ করেছে। মঙ্গলকাব্যের উন্মেষ পর্যায়ে পঞ্চাদশ শতাব্দীতে রচনারীতি গতানুগতিক ছিল। মঙ্গলকাব্যগুলোকে শ্রেণীগত দিক থেকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-
- পৌরাণিক
- লৌকিক
পৌরাণিক শ্রেণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – গৌরীমঙ্গল, ভবানীমঙ্গল, দুর্গামঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কমলামঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, চন্ডিকামঙ্গল ইত্যাদি। লৌকিক শ্রেণী হল – শিবায়ন বা শিবমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, কালিকামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, রায়মঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সারদামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল ইত্যাদি।

মঙ্গলকাব্যের উৎপত্তির উৎস এদেশের সুপ্রাচীন ধর্মাদর্শের সঙ্গে বিজড়িত। মঙ্গলকাব্যগুলো দেবদেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও এতে বাঙ্গালী জীবনের ইতিহাস প্রতিফলিত হয়েছে। তুর্কি আক্রমনের ফলে আকস্মিক সামাজিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলকাব্যগুলোর উদ্ভব হয়েছিল বলে তাতে সমাজমানসের দৈবনির্ভরশীলতা প্রকাশ পেয়েছে। চৈতন্যোত্ত কালে মঙ্গলকাব্যের আদর্শ শিথিল হয়ে পড়ে এবং ত ৎকালীন সমাজের দৈবভক্তিহীনতার বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে।
- মঙ্গলকাব্যের সুদীর্ঘ গীতিকাহিনী বিভিন্ন পালায় বিভক্ত। পালা বিভাগ ছিল বিষয়ভিত্তিক।
- চন্ডীমঙ্গল আট দিনে গীত হয়।প্রত্যেক দিনের জন্য দিবা পালা ও রাত্রি পালায় কাহিনী ভাগ করা ছিল।আট দিনে ষোল পালার বিভাগই মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বিভাগ।
- দিবা পালা দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত এবং রাত্রি পালা সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত।
- চন্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ষোল পালায় বিভক্ত থাকলেও ধর্মমঙ্গল বার দিনের চব্বিশ পালায় বিভক্ত ছিল।
- মনসামঙ্গল প্রতিদিন এক পালা করে গাওয়া হত এবং এক মাসের উপযোগী ত্রিশ পালায় বিভক্ত ছিল।
- সকল মঙ্গলকাব্যের গানের শেষ রাত জেগে গান গাওয়া হত।পরদিন দিবা পালায় ফলশ্রুতি শোনার পর গান শেষ হত।
- কাহিনীর বাইরে ফলশ্রুতিকে বলা হয় অষ্টমঙ্গলা। এতে কবি আত্নপরিচয় ও কাব্যরচনার কালের উল্লেখ করতেন।
সকল মঙ্গলকাব্যই দৈব আদেশে রচিত। মঙ্গলকাব্য প্রধানত পয়ার ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছ। মঙ্গলকাব্যে বার মাসের সুখদুঃখের বর্ণনা বারমাসী এবং চৌত্রিশ অক্ষরে রচিত দেবস্তোত্র চৌতিশা অন্তর্ভুক্ত থাকত। মঙ্গলকাব্যে বাস্তব জীবনের তুচ্ছ সুখদুঃখ আশা-আকাংক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে বলে মঙ্গলকাব্যগুলো উপন্যাসধর্মী। বর্ণ্নার প্রত্যক্ষতা মঙ্গলকাব্যের একটি বিশেষ গুণ। মঙ্গলকাব্যের প্রথম যুগের ভাষা স্থূল ও গ্রাম্যভাবাপন্ন, মধ্যযুগের ভাষা সহজ ও সাবলীল এবং শেষ যুগের ভাষা অলঙ্কার সমৃদ্ধ।