মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম গৌরব বৈষ্ণব পদাবলী।রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে এই অমর কবিতাবলীর সৃষ্টি এবং বাংলাদেশে শ্রীচৈতন্যদেব প্রচারিত বৈষ্ণব মতবাদের সম্প্রসারণে এর ব্যাপক বিকাশ।জয়দেব-বিদ্যাপতি-চন্ডীদাস থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বৈষ্ণব গীতিকবিতার ধারা প্রচলিত হলেও প্রকৃতপক্ষে ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে এই সৃষ্টিসম্ভার প্রাচুর্য ও উৎকর্ষপূর্ণ ছিল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ফসল বৈষ্ণব পদাবলী।
- পদাবলী সাহিত্য বৈষ্ণবতত্তের রসভাষ্য।
- বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণবসমাজে মহাজন পদাবলী এবং বৈষ্ণব পদকর্তাগণ মহাজন নামে পরিচিত।
- বৈষ্ণবমতে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। এই প্রেম সম্পর্ককে বৈষ্ণব মতাবলম্বীগ্ণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা রুপকের মাধ্যমে উপলব্ধি করেছেন।
- বৈষ্ণবদের উপাস্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
- বৈষ্ণবেরা ভগবান ও ভক্তের সম্পর্কের স্বরুপ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণকে পরমাত্না বা ভগবান এবং রাধাকে জীবাত্না বা সৃষ্টির স্বরুপ মনে করে।
চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) যুগান্তকারী আবির্ভাবের পূর্বেই রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার মাধুর্য পদাবলীগানের উপজীব্য হয়েছিল।বৈষ্ণব ধর্মমতকে কেন্দ্র করে যে বৈচিত্র্যধর্মী সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে তাকে বৈষ্ণব সাহিত্য নামে চিহ্নিত করা হয়।কাব্যগত উতকর্ষের দিক থেকে অপরাপর সাহিত্যের চেয়ে পদাবলীর স্থান সর্বোচ্চে।

বৈষ্ণব পদাবলীর মধুর রসের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের রুপকাশ্রয়ে ভক্ত ও ভগবানের নিত্য বিরহমিলনের যে লীলাবৈচিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য নিহিত।
- আধুনিক গীতিকবিতায় কবিহৃদয়ের বিচিত্র্য ভাবের ছন্দোময় প্রকাশ ঘটে।
- বস্তুর সঙ্গে কবির আত্নিক সংযোগ সাধিত হয়ে কাব্যরুপের সৃষ্টি হয়।
- গোষ্ঠীগত চেতনায় কবিরা ছিলেন উদ্বুদ্ধ।
- রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাই পদাবলীর উপজীব্য, কিন্তু বিষয় বৈচিত্র্য গীতিকবিতার প্রধান দিক।
- বৈষ্ণব কবিতায় বৈষ্ণবতত্ত্বের প্রতিফলন ঘটেছে।
রাধা ও কৃষ্ণকে নিছক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করলে তাদের প্রেমলীলা বাস্তব নরনারীর জীবনের পরিচয় ফুটিয়ে তোলে। শ্রীরাধার অঙ্গাবরণের এক পিঠে রসরঙ্গের রক্তিম উচ্ছাস, আরেক পিঠে গৈরিক বৈরাগ্য।
বিদ্যাপতি
মিথিলার কবি বিদ্যাপতি বাঙালি না হয়েও অথবা বাংলায় কবিতা রচনা না করেও বাঙালি বৈষ্ণবের গুরুস্থানীয়, রসিক বাঙ্গালির শ্রদ্ধেয় কবি, বৈষ্ণব সহজিয়া সাধকদের নবরসিকের অন্যতম।তিনি একাধারে কবি,শিক্ষক,কাহিনীকার,ঐতিহাসিক,ভূবৃত্তান্ত লেখক ও স্মার্ত নিবন্ধকার হিসেবে ধর্মকর্মের ব্যবস্থাদাতা ও আইনের প্রামাণ্য গ্রন্থের লেখক ছিলেন।
- বিদ্যাপতি দ্বারভাঙ্গা জেলার অন্তর্গত বিসফী নামক গ্রামে ব্রামহ্ণ বংশে জন্মগ্রহণ করে।
- কবি বিদ্যাপতি মৈথিল কোকিল ও অভিনব জয়দের নামে খ্যাত।
- তার অন্যান্য উপাধি ছিল-নব কবিশেখর, কবিরঞ্জন,কবিকন্ঠহার,পন্ডিত ঠাকুর,সদুপাধ্যায়,রাজপন্ডিত ইত্যাদি।
- বিদ্যাপতির জীবনকথা মিথিলার রাজবংশের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িত ছিল।
- বিদ্যপতি ভারতচন্দ্রের মতই নাগরিক জীবনের কবি।
- বিদ্যাপতি ১৩৬০-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পরলোকগমন করেন।
বিদ্যাপতির কবিতা রসজ্ঞ রাজন্যবর্গ ও রাজসেবক কর্মচারিগণের রসতৃষ্ণ মিটানোর জন্য রচিত হয়েছিল।কবি,রসিক,পন্ডিতো ভাষার যাদুকর বিদ্যাপতি সংস্কৃত অবহটঠ ও মৈথিল বুলিতে তাঁর জ্ঞান,চিন্তা,রসবোধ ও কাব্যকুশলতার সার্থক পরিচয় দান করেন।
- অপভ্রংশে তিনি কীর্তিলতা নামে ঐতিহাসিক কাব্য লিখেছিলেন।
- নিজ ভাষা মৈথিলিতে রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা বিষয়ক যে অত্যুৎকৃষ্ট পদাবলী রচনা করেছিলেন তাই তাকে অমরতা দান করেছে।
- তাঁর পদাবলী আসাম উড়িষ্যা ও পূর্ববিহারে সমাদৃত।
- দীর্ঘ ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যাপতি কবিতা লিখেছেন,দশ-বার জন শাসকের উত্থানপতন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন।
- বাংলাদেশে বিদ্যাপতি পদকর্তা হিসেবে পরিচিত।
বিদ্যাপতি বিচিত্র বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। “বিভাগসার”, “দানবাক্যাবলী”,পান্ডিত্য-বিচার সম্বলিত স্মৃতিগ্রন্থ। “বর্ষক্রিয়া”,”গঙ্গাবাক্যাবলী”,”দূর্গাভক্তিতরঙ্গিণী”,”ব্যাড়ীভক্তিতরঙ্গিণী” পৌরাণিক হিন্দুর পূজা ও সাধনপদ্ধতির সঞ্চায়ন।”কীর্তিলতা”,”কীর্তিপতাকা” উতকৃষ্ট ইতিহাসগ্রন্থ। “ভূপরিক্রমা” ভৌগোলিকের তীর্থ পরিক্রমা। “পুরুষপরীক্ষা” মণীষা ও শিল্পকৃতির সমন্বয়রুপ কথাসাহিত্য। “লিখনাবলী” অলঙ্কার শাস্ত্রবিষয়ক গ্রন্থ।
মাতৃভাষা মৈথিলি ছাড়া আরও তিনটি ভাষায় তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
- বিদ্যাপতির স্মৃতি ও ধর্মশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ ও পুরুষপরীক্ষা সংস্কৃত ভাষায় রচিত।
- কীর্তিলতা ও কীর্তিপতাকা অবহটঠ ভাষায় রচিত।
- বাংলাদেশে প্রচলিত বিদ্যাপতি পদাবলীর ভাষা ব্রজবুলি।
বিদ্যাপতি সহস্রাধিক পদাবলী রচনা করেছিলেন।রাধাকৃষ্ণের উল্লেখ আছে এমন পদের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।বিদ্যাপতিই কাম-প্রেম বিচিত্র বর্ণালী জগতের প্রথম ও প্রধান সার্থক স্রষ্টা। বিদ্যাপতির পদাবলীতে ধর্মীয় আবেগের চেয়ে রসবোধই বেশি। তিনি রাধাকৃষ্ণের পদই বেশি রচনা করেছিলেন।বাংলাদেশে বিদ্যাপতির সব পদই রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক।
চণ্ডীদাস
বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর আদি রচয়িতা কবি চন্ডীদাস।সম্ভবত তিনি চতুর্দশ শতকের শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।শিক্ষিত বাঙালি বৈষ্ণব সাহিত্যের রস ও আনন্দের সংবাদ পেয়েছে চন্ডীদাসের পদাবলী থেকে।চন্ডীদাস রাধাকে কৃষ্ণপ্রেমে

আত্নহারারুপে চিত্রিত করেছেন।কবি তাকে মর্ত্যলোক থেকে বহু দূরদুর্গম অধ্যাত্নতীর্থে স্থান দিয়েছেন।
চন্ডীদাস শব্দঝংকারে নিঃস্ব, তাঁর ভান্ডারে দু চারটি মাটির অলঙ্কার ও মাঠের ফুল ভিন্ন কোন হিরামাণিক্য নেই।চন্ডীদাসের ভাষা জাতির হৃদয়কে সিক্ত করেছিল।বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের তুলনায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
- বিদ্যাপতি সুখের কবি, চন্ডীদাস দুঃখের কবি।
- বিদ্যাপতি প্রেমকে জগতের সার বলেছিলেন, চন্ডীদাস প্রেমকে জগত বলেছেন।
- বিদ্যাপতি ভোগ করিবার কবি, চন্ডীদাস সহ্য করিবার কবি।
- বিদ্যাপতির রাধা তরুণী নায়িকা, চন্ডীদাসের রাধা প্রবীণা নায়িকা।
বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের প্রতিভা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চটোপাধ্যায় বলেছেন-
- বিদ্যাপতির কবিতা স্বর্ণহার, চন্ডীদাসের কবিতা রুদ্রাক্ষমালা।
- বিদ্যাপতির গান মুরজবীণাসঙ্গিনী,চন্ডীদাসের গান সায়াহ্ন সমীকরণের দীর্ঘনিঃশবাস।
জ্ঞানদাস
সম্ভবত ষোড়শ শতাব্দীতে বর্ধ্মান জেলায় কবি জ্ঞানদাসের জন্ম। তিনি ছিলেন চন্ডীদাসের ভাবশিষ্য।তিনি ব্রজবুলি ও বাংলায় পদ রচনা করেছিলেন কিন্তু বাংলা পথেই তার কৃতিত্ব বেশি।

জ্ঞানদাস পদাবলীতে সৌন্দর্যের ব্যঞ্জনা দিয়েছেন, আবেগের সূক্ষ কারুকর্ম ফুটিয়ে তুলেছেন।তিনি তপস্বিনী রাধার নিরাভরণ ও নিরলঙ্কার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন।চন্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের পদের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে।
- জ্ঞানদাস ছিলেন শিল্পী, চন্ডীদাস ছিলেন সাধক।
- জ্ঞানদাস রাধার বেদনাকে পরিস্ফুট করে তুললেও তাকে হর্ষোতফুল্ল মিলন-ব্যাকুলা সুরসিকা নায়িকা হিসেবে রুপ দিয়েছিলেন।
- জ্ঞানদাস চৈতন্যপরবর্তী কবি বলে ভাবের বৈচিত্র্য দেখিয়েছিলেন।
জ্ঞানদাসের ভাষা সহজ,সরল, অলঙ্কারবর্জিত, কিন্তু প্রবল আবেগে পরিপূর্ণ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দার্শনিক তত্ত্ব ও মননশীলতা।
গোবিন্দদাস
সম্ভবত ষোড়শ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে গোবিন্দদাসের জন্ম এবং সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে তাঁর মৃত্যু হয়।তিনি প্রায় সাত শ পদ রচনা করেছিলেন বলে অনুমান করা হয়।তিনি ছিলেন ভক্তকবি। তিনি ছিলেন বিদগ্ধ কবি, রুচির রসিক ও শান্তভক্ত।গোবিন্দদাস ছিলেন সংস্কৃত শাস্ত্রে অসাধারণ পন্ডিত। গোবিন্দদাসের বর্ণনায় বহিরঙ্গের মাধুর্য প্রাধান্য পেয়েছে। ছন্দ, অলঙ্কার ও পদবিন্যাসে তিনি যে বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন তা একক ও তুলনারহিত।